শিক্ষক দিবস: জনস্বপ্নহীন লেখাপড়া, মুখস্তবিদ্যায় দক্ষতার আর সৃশীলতার অপমৃত্যু
সারা বিশ্বের মতো ৫ অক্টোবর বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচিতে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য— কাঙ্খিত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই, তেমনি শিক্ষক সংকট ঠেকাতে প্রয়োজন দুনিয়াব্যাপি উদ্যোগ’। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ শুমারি (২০২১) অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক স্তরে প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষক আছেন সাড়ে ৬ লাখের বেশি। যার মধ্যে সরকারি শিক্ষক ৩ লাখ ৫৯ হাজার জন। আর বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, মাধ্যমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত মোট শিক্ষক আছেন প্রায় ছয় লাখ।
৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও এই রাষ্ট্র এখনো একটা কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। শিক্ষার লক্ষ্য কি হবে? মাধ্যম কি হবে? কত বছর বয়স থেকে শিক্ষা শুরু হয়ে নূন্যতম কত বছর পড়ালেখা জরুরী? ভিন্ন ভিন্ন ধারার মধ্যে ঐক্য এবং সমন্বয় কিসের ভিত্তিতে হবে? পরীক্ষা কোন স্তরে এবং কি পদ্ধতিতে হবে? পাশের হার নির্ণয়নে মূল বিবেচ্য কি হবে? স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে পড়ালেখা করানোর যৌক্তিকতা কি? কেন জনগনের করের টাকা শিক্ষায় ব্যয় বা অপচয় করা হবে? দেশের টাকায় বিদেশী সংস্কৃতি ও নাগরিক তৈরীর প্রকল্প কি চলমান থাকবে? শিক্ষা কি সেবা না পন্য? সার্বজনীন নাগরিক অধিকার নাকি অন্য কিছু? রাষ্ট্র কি সকলকে বিনামূল্যে পড়াতে বাধ্য, যদি তাই হয়, তাহলে কোন স্তর পর্যন্ত? শিক্ষক কারা হবেন, তাদের বেতন স্কেল/সুযোগ-সুবিধা আর নিয়োগ পদ্ধতি কি হবে? বাজেটে শিক্ষা ও গবেষনার ব্যয় কেমন হবে?
উত্তর ঔপনিবেশিক আমলে যদি স্বাধীন স্বত্তায় বিকশিত হয়ে গনপ্রজাতন্ত্র গঠন করতে হয়, তাহলে এই প্রশ্নগুলো যথেষ্ট তর্ক, বিতর্ক, আলোচনা, পর্যালোচনা, বিশ্লেষন সাপেক্ষে সমাধান করতে হবে। দুখঃজনক হলেও সত্য যে এই রাষ্ট্র ও বড় রাজনৈতিক দলগুলো গত অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এই মৌলিক জায়গাতে কোন রাজনৈতিক প্রস্তাবনা হাজির করতে পারেনি যা সমাজের ব্রাত্যজনের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারে। ছাত্র রাজনীতির নামে দেশে যা চলছে, তা কোনভাবেই শিক্ষা ও শিক্ষার্থী বান্ধব নয় বরং নির্লজ্জ বেহায়াপনা আর তৃতীয় শ্রেনীর গ্রাম্য গুটিবাজী।
একটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের লালন ও পালন করানো; নিজের জমিন, মানুষ, সমাজ, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ও সারা দুনিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারনা দেয়া যাতে সে দেশের ও দুনিয়ার একজন গর্বিত ও মানবিক নাগরিক হতে পারে। পাশাপাশি ৩-৫ টি ভাষা শিখানো, উপযুক্ত প্রযুক্তি জ্ঞান এবং চার/পাঁচটা জীবনমুখী দক্ষতা শেখানো যাতে সে স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং মর্যাদাসম্পন্ন জীবন যাপন করতে পারে; পড়া, লেখা, চিন্তা ও বিশ্লেষন করতে শেখানো যাতে মননশীলতা তৈরী হয়, আত্মিক পরিশুদ্ধতা লাভ করতে পারে – ভালো-খারাপ, ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিকের পার্থক্য করতে জানে। কিন্তু এগুলো তাদেরকে শেখাবে কে? কম বেতনে, অন্য কোন কাজ না পেয়ে, কোন প্রশিক্ষন ছাড়া, কোন রকম চাকুরী করা শিক্ষকদের দিয়ে কি দিকবিজয়ী বীর ও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী, নেতা, আমলা, প্রশাসক, সেনাপতি তৈরী করা যায় ! ফ্যাসিবাদের আমলে যারা সম্মতি ছাড়া কোটি কোটি মানুষকে শাসন ও শোষন করছে, তাদের জন্য এগুলো শুধুই ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’র মত।